Social Welfare
২ থেকে ৫৯৭: ভারতের কঠিনতম পরীক্ষায় একলব্য স্কুলের শিক্ষার্থীদের অসাধারণ কৃতিত্ব
Posted On:
13 NOV 2025 10:38AM
১৩ নভেম্বর ২০২৫
দূর-দূরান্তের আদিবাসী গ্রাম থেকে উঠে এসে, ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে একলব্য মডেল রেসিডেনশিয়াল স্কুল (EMRS)-এর ৫৯৭ জন শিক্ষার্থী JEE Main, JEE Advanced এবং NEET-এর মতো ভারতের সর্বাধিক প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে, যা মাত্র ২ জন (২০২২–২৩) উত্তীর্ণ শিক্ষার্থী থেকে এক অসাধারণ অগ্রগতি। এই সাফল্য প্রমাণ করে যে লক্ষ্যভিত্তিক শিক্ষাসহায়তা কীভাবে দেশের সর্বাধিক বঞ্চিত ও দুর্গম এলাকায় বসবাসকারী তফসিলি উপজাতি শিক্ষার্থীদের জীবন বদলে দিচ্ছে। মোট ২৩০-টি EMRS-এর মধ্যে যেগুলিতে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত পাঠদান হয়, তার মধ্যে ১০১-টি বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা এ বছর এই মর্যাদাপূর্ণ পরীক্ষাগুলি উত্তীর্ণ হয়েছে।
উজ্জ্বল উদাহরণ হিসেবে রয়েছেন হিমাচল প্রদেশের বাস্পা উপত্যকার সাংলা গ্রামের যতীন নেগি। কঠিন শীত, তুষারবন্দি অবস্থা এবং ঘনঘন বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্নতার মতো প্রতিকূল পরিবেশে বড় হয়ে ওঠা সত্ত্বেও, তিনি JEE Advanced-এ সর্বভারতীয় র্যাঙ্ক ৪২১ অর্জন করে বর্তমানে IIT জোধপুরে B.Tech পড়ছেন।
গুজরাটের খাপাটিয়া গ্রামের পদভি উর্জসভিন অমৃতভাই, যিনি EMRS বারতাদে পড়াশোনা করেছেন, NEET উত্তীর্ণ হয়ে আজ GMERS মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল, জুনাগড়ে MBBS করছেন। তাঁর সাফল্য শিক্ষার শক্তি, অধ্যবসায় এবং স্বপ্নপূরণের দৃঢ়তাকে সামনে আনে।
তাদের গল্পগুলি স্পষ্ট করে দেখায় - একলব্য মডেল রেসিডেনশিয়াল স্কুল কীভাবে শিক্ষার্থীদের জীবনে জীবন পরিবর্তনের সুযোগ তৈরি করছে।
EMRS শিক্ষার্থী যারা IIT-JEE Mains, JEE-Advanced ও NEET পাশ করেছে (2024-25)
(টেবিল চিত্র)
বছরের পর বছর পারফরম্যান্স তুলনা (গত ৩ শিক্ষাবর্ষ)


IIT-JEE এবং NEET পরীক্ষা কি?
ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি (IIT) হল, দেশের শীর্ষস্থানীয় প্রযুক্তি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। JEE (Joint Entrance Examination) সমগ্র ভারতীয় স্তরের প্রকৌশল প্রবেশিকা পরীক্ষা, যা দুই ধাপে অনুষ্ঠিত হয়, JEE Main ও JEE Advanced। JEE Main-এ উত্তীর্ণ পরীক্ষার্থীরাই JEE Advanced দিতে পারে, এবং এই পরীক্ষার মাধ্যমে দেশে অবস্থিত ২৩-টি IIT-এ ভর্তি নির্ধারিত হয়।
NEET (National Eligibility-cum-Entrance Test) হল, ভারতের সকল মেডিকেল কলেজে স্নাতকস্তরের (MBBS/BDS) ভর্তির জন্য একমাত্র জাতীয় পরীক্ষা।
একলব্য মডেল রেসিডেনশিয়াল স্কুল (EMRS)
তফসিলি উপজাতি শিক্ষার্থীদের মানসম্মত শিক্ষা প্রদানের উদ্দেশ্যে আদিবাসী বিষয়ক মন্ত্রকের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত EMRS-গুলি আদিবাসী শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা ও পেশাগত শিক্ষায় এগিয়ে যাওয়ার পথ তৈরি করে।
বর্তমানে দেশে ৪৮৫-টি কার্যকরী EMRS-এ ১,৩৮,৩৩৬ জন ছাত্রছাত্রী (২০২৪–২৫) অধ্যয়নরত। সর্বমোট ৭২২-টি স্কুল অনুমোদিত, এবং স্কুলগুলির নির্মাণ ও পরিচালনার জন্য মোট ₹৬৮,৪১৮ লক্ষ বরাদ্দ হয়েছে।
সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৭৫(১)-এর অধীনে রাজ্য সরকারগুলিকে যে অনুদান দেওয়া হয়, তা স্কুল নির্মাণ এবং পুনরাবৃত্ত খরচ মেটাতে ব্যবহৃত হয়। এই অনুদান তফসিলি উপজাতিদের কল্যাণ নিশ্চিত করার জন্য ভারতীয় সংবিধানে প্রদত্ত একটি সাংবিধানিক নিশ্চয়তা।
EMRS স্কিমটি ১৯৯৭–৯৮ সালে চালু হয়। ২০১৮–১৯ সালের বাজেটে ঘোষণা করা হয় যে যেসব ব্লকে ৫০% বা তার বেশি ST জনসংখ্যা এবং অন্তত ২০,০০০ জন উপজাতি বাস করে, সেখানে EMRS প্রতিষ্ঠা করা হবে। ৩১ জুলাই ২০২৫ পর্যন্ত ৭২২-টি EMRS অনুমোদিত হয়েছে, যার মধ্যে ৪৮৫টি ইতিমধ্যেই চালু হয়েছে।
EMRS-গুলির সম্প্রসারণের ফলে স্থানীয় আদিবাসী সম্প্রদায়ের শিক্ষার্থীরা নিজেদের পরিবেশের মধ্যেই CBSE-অনুমোদিত বিনামূল্যে, উচ্চমানের শিক্ষা, হোস্টেল, বিজ্ঞানাগার, ক্রীড়া সুবিধা, পুষ্টিকর খাদ্য, স্বাস্থ্যসেবা এবং কেরিয়ার গাইডেন্স পাচ্ছে—যা তাদের সামগ্রিক বিকাশ এবং সামাজিক-অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
EMRS- এর অগ্রগতি ফলাফলের দিকে পরিচালিত করে
যতীন নেগি হলেন সেই শত শত শিক্ষার্থীর একজন, যিনি EMRS-এর শিক্ষা সহায়তার ফলে জীবনের পথ বদলে নিতে পেরেছেন। তিনি ২০১৭ সালে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হন EMRS নিছারে।
হিমাচলের দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে বসবাস করায় তাঁর স্কুল জীবন বারবার ব্যাহত হয়েছে। প্রতিটি শীতে ভারী তুষারপাতের কারণে তাঁদের গ্রাম বাইরের জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত।
চিত্র ১ – যতীন নেগির বাড়ি সাংলা, কিন্নৌর (হিমাচল প্রদেশ)
চিতকুল গ্রামের দৃশ্য (সাংলা উপত্যকা থেকে প্রায় ২০ কিমি দূরে), যেটি তিব্বতের সীমানার কাছে গ্রেটার হিমালয়ে অবস্থিত। হোস্টেলে ভর্তি হওয়ার পর EMRS-এর শিক্ষকরা তাঁর পড়াশোনার দিক নির্দেশনা দেন। সে সময়ই তিনি একটি স্থির ও নিয়মতান্ত্রিক রুটিনে অভ্যস্ত হন। নেগির কথায়, “ধীরে ধীরে আমি বুঝতে শুরু করলাম বাইরের পৃথিবী কীভাবে চলে।”
EMRS-এ পড়ার সময়ই তাঁর মেধা ও পরিশ্রম সামনে আসে। শিক্ষকেরা তাঁকে এবং তাঁর সহপাঠীদের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য তৈরি করতে শুরু করেন। তিনি বলেন, “আমাদের শুধু বোর্ড পরীক্ষার জন্য প্রচলিত পদ্ধতিতে পড়ানো হয়নি। বরং প্রতিযোগিতামূলক দৃষ্টিভঙ্গিতে পড়ানো হতো। নিয়মিত পরীক্ষা হতো। প্রতিটি পরীক্ষার পর গ্রেড ও নম্বরসহ বিস্তারিত ফিডব্যাক দিতেন। আমাদের সর্বদা উন্নতির জন্য উৎসাহিত করা হতো। এই নিয়ম, শৃঙ্খলা ও ধারাবাহিকতা আমাদের শেখার ধরণই বদলে দিয়েছিল।”
২০২৪ সালে, দ্বাদশ শ্রেণীতে, যখন তিনি পড়ছেন নেগির বাবা মারা যান। গভীর মানসিক আঘাত সত্ত্বেও তিনি পড়াশোনায় মনোযোগ ধরে রাখতে চেষ্টা করেন। সেই বছর তাঁর পারফরম্যান্স ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শিক্ষকেরা তাঁকে এই কঠিন সময়ে মানসিকভাবে সহায়তা করেন। যতীন এক বছরের বিরতির পর পুনরায় পরীক্ষার প্রস্তুতি নেন, এবং সাফল্য অর্জন করেন।
পরিশেষে JEE Advanced উত্তীর্ণ হয়ে সর্বভারতীয় র্যাঙ্ক ৪২১ অর্জন করলে তাঁর পরিবার ও গ্রামের মানুষ আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওঠেন, যদিও অনেকেই আগে IIT সম্পর্কে জানতেন না।
পদভি উর্জস্বীবেন অমৃতভাই দৃঢ় বিশ্বাস করেন যে পরিশ্রমই সাফল্যের একমাত্র পথ। গুজরাটের খাপাটিয়া নামে মাত্র কয়েকশো মানুষের ছোট একটি গ্রাম তাঁর জন্মস্থান। পরিবারের দুই বোনের একজন তিনি। তাঁর কথায়, “গ্রামের লোকেরা বাবা-মাকে বলত, ‘তোমাদের ছেলে নেই, মেয়েরা কী করবে?’” অমৃতভাইয়ের জন্য স্কুলজীবন সহজ ছিল না। তিনি নন-গুজরাটি মাধ্যমের কারণে পড়াশোনায় অসুবিধা অনুভব করতেন এবং ক্লাসে আত্মবিশ্বাসের অভাব ছিল।
সৌভাগ্যক্রমে, EMRS-এর এক শিক্ষক তাঁর পাশে দাঁড়ান, তাঁকে অনুপ্রাণিত করেন, উৎসাহ দেন, এবং ঠিক পথে এগিয়ে যাওয়ার সহায়তা করেন। অসংখ্য বাধা অতিক্রম করে অমৃতভাই অসাধারণ ফলাফল করেন, তিনি NEET পরীক্ষায় ১১,৯২৬ র্যাঙ্ক অর্জন করেন। এই সাফল্য তাঁর কাছে শুধু একটি র্যাঙ্ক নয়, বরং প্রমাণ যে শিক্ষা ও কঠোর পরিশ্রম সামাজিক বাধা ও বৈষম্য ভাঙার শক্তিশালী হাতিয়ার।
শিক্ষায় সমতা প্রতিষ্ঠায় আইন ও সংবিধানের ভূমিকা
ভারতের শিক্ষাগত সমতা প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি তার সংবিধানে নিহিত, যা পরবর্তীতে গুরুত্বপূর্ণ আইন প্রণয়নের মাধ্যমে আরও শক্তিশালী হয়েছে। অ্যাফার্মেটিভ অ্যাকশন এমন একটি ব্যবস্থা যা সকল সামাজিক পটভূমির শিক্ষার্থীদের সমান প্রতিযোগিতার সুযোগ নিশ্চিত করে, যাতে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল বা সামাজিকভাবে বঞ্চিত শিক্ষার্থীরা দীর্ঘমেয়াদে পিছিয়ে না পড়ে।
সংবিধানগত কাঠামো
ভারতের সংবিধান মৌলিক অধিকার এবং রাষ্ট্রের নীতিনির্দেশক তত্ত্ব (Directive Principles of State Policy) এর মাধ্যমে দুর্বল সম্প্রদায়ের শিক্ষাগত ও অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষায় রাষ্ট্রকে স্পষ্টভাবে ক্ষমতা ও দায়িত্ব প্রদান করে।
DPSP-এর এই অনুচ্ছেদে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, রাষ্ট্র সমাজের দুর্বল শ্রেণির, বিশেষতঃ তফসিলি উপজাতি (ST) ও তফসিলি জাতি (SC)-এর শিক্ষাগত ও অর্থনৈতিক স্বার্থ উন্নীত করবে এবং তাদের সামাজিক অবিচার ও শোষণ থেকে রক্ষা করবে।
সংবিধানের এই দুইটি ধারা (যা মৌলিক অধিকারের অংশ) রাষ্ট্রকে অনুমতি দেয়, সামাজিক ও শিক্ষাগতভাবে অনগ্রসর শ্রেণি, অথবা ST ও SC-দের উন্নতির জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিশেষ বিধান (affirmative action) গ্রহণ করতে। এই বিশেষ বিধান প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতেও প্রযোজ্য (সংখ্যালঘু প্রতিষ্ঠান ব্যতীত) এবং এটি Article 29(2)-র একটি ব্যতিক্রম, যেখানে বলা হয়েছে যে কেবল ধর্ম, বর্ণ, জাতি, ভাষা ইত্যাদির ভিত্তিতে কাউকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি দিতে অস্বীকার করা যাবে না।
আইন
এই সংবিধানগত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েই Central Educational Institutions (Reservation in Admission) Act, 2006 প্রণীত হয়। এই গুরুত্বপূর্ণ আইনে কেন্দ্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত, পরিচালিত বা আর্থিক সাহায্যপ্রাপ্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সংরক্ষণের ব্যবস্থা নির্ধারণ করা হয়েছে ঃ 15% - তফসিলি জাতি (SC), 7.5% - তফসিলি উপজাতি (ST), ও 27% - অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি (OBC)
আইনটি আইআইটি, এনআইটি, আইআইএম এবং কেন্দ্রীয় মেডিকেল কলেজসহ কেন্দ্রীয় সহায়তাপ্রাপ্ত সমস্ত শীর্ষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রযোজ্য। অ্যাফার্মেটিভ অ্যাকশনের কাঠামো বিচারিক ব্যাখ্যা ও আইনগত সংশোধনের মধ্য দিয়ে সময়ের সঙ্গে আরও পরিমার্জিত হচ্ছে।
EMRS-এর মাধ্যমে বিশেষ একাডেমিক সহায়তা
National Education Society for Tribal Students (NESTS) - যা উপজাতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা - EMRS পরিচালনা ও বাস্তবায়নের দায়িত্বে রয়েছে। EMRS-এ অধ্যয়নরত তফসিলি উপজাতি শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনকে আরও শক্তিশালী করতে বিভিন্ন বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

তথ্যসূত্র
Press Information Bureau:
Others:
Download in PDF
**
SSS/SS
(Features ID: 156017)
Visitor Counter : 12
Provide suggestions / comments